
মোশারফ হোসাইন তযু-নিজস্ব প্রতিবেদক: গাজীপুরের শ্রীপুরে কয়েকটি পরিবারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ভূমিদস্যু, বনদস্যু ও সন্ত্রাস বাহিনী মিলে পরিবারগুলোর বসতঘর, দোকানপাঠ ও পাকা বাউন্ডারি ভেঙে জমি দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, উপজেলার টেপির বাড়ি গ্রামের জোবেদ আলীর ছেলে ষাটোর্ধ আবদুল মোতালিব স্বাস্থ্য সহকারী পদে চাকরি করার পাশাপাশি ব্যবসার লাভের টাকা আস্তে আস্তে জমিয়ে ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে মাওনা চৌরাস্তা বনরুপা সিনেমা হল সংলগ্ন ৩২ বছর আগে সাফ কবলা দলিল মূলে ১৯ শতাংশ জমি ক্রয় করে শান্তিপূর্ণভাবে দখল করে আসছে। জমিতে ৬টি বসতবাড়ি নির্মাণ ও ৯টি দোকান ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দেয়ার পাশাপাশি একটি ‘ল চেম্বার ছিল ওই জমিতে। সেখানে আবদুল মোতালিব থাকতেন পরিবার নিয়ে। অবসর নেওয়ার পর মার্কেট থেকে যা ভাড়া আসত, তা দিয়েই চলত সংসার। হঠাৎ এ জমি দখলে মরিয়া হয়ে ওঠেন সৈয়দ হুমায়ূন কবীর নামে ধনাঢ্য এক ব্যবসায়ী। কামরুজ্জামান খসরু তালুকদার নামে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে কালিয়াকৈরের সেই নিহত বনখেকো জসীমকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ভাড়া করে আনেন তিনি।
এর পরের ঘটনা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়:
১৩ জুলাই গভীর রাতের ঘটনা। প্রায় দুই শতাধিক মানুষ হঠাৎ মাওনা চৌরাস্তা মোড়ে অবস্থান নেয়। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে পিস্তল, কেউ আবার মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে আছে মহাসড়কের পাশে। বুলডোজার দিয়ে প্রথম আঘাতটি করা হয় আবদুল মোতালিবের বসতঘরে। সেদিন তারা গ্রামের বাড়ি ছিলেন।
আবদুল মোতালিব শ্রীপুর বার্তাকে বলেন, খবর পেয়ে জমির পাশে এসে দেখি স্বপ্নের ভুবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় কাজল ফকির, মজনু ফকির, ওয়াজ কুরনীসহ কয়েক যুবকের ছত্রছায়ায় জসীম এতে নেতৃত্ব দেয়। এসময় বসতবাড়ি ও দোকান ঘরের মালামালসহ প্রায় তিন কোটি টাকা লুটপাট করে তারা।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার আগের দিন শ্রীপুর থানার ওসি (অপারেশন) হেলাল উদ্দিন ও এসআই আজহার তাকে সৈয়দ হুমায়ূন কবীরের সঙ্গে বিষয়টি মীমাংসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। রাতেই প্রায় সাত কোটি টাকা মূল্যের এ জমি জবরদখল হয়ে যায়। সাজানো- গোছানো মোতালিবের বসতবাড়ি, মার্কেট আর চালের মিল এক রাতেই বিরানভূমিতে পরিণত হয়। চারদিকে ইটের সীমানা প্রাচীর দিয়ে আবদ্ধ করে ফেলা হয়। পরদিন থানায় গিয়ে আইনি সহায়তা চাইলেও পাননি, এমনকি জিডিও নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন মোতালিব।
এ ব্যাপারে ওসি (অপারেশন) হেলাল উদ্দিন শ্রীপুর বার্তাকে বলেন, মোতালিব থানায় আসার পর তাকে আদালতে যাওয়ার পরার্মশ দেওয়া হয়েছিল। এর বাইরে আর কিছুই তার জানা নেই। জবরদখলের পর জমিতে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন সৈয়দ হুমায়ূন কবীর।
শনিবার (২০ অক্টোবর) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কৌশল হিসেবে সীমানা প্রাচীরের ভেতরের চারদিকে একটি কোম্পানির শত শত নতুন ট্রাকের বডি দিয়ে আরও একটি প্রাচীর দিয়ে রাখা হয়েছে। ওই জমি উদ্ধারে পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে মোতালিবের মেয়ে অ্যাডভোকেট শাহনাজ পারভীন জেলা পুলিশ সুপারের কাছে ১৩ সেপ্টেম্বর সৈয়দ হুমায়ূন কবীরকে অভিযুক্ত করে আবেদন করেন। জমি ফিরে পেতে আদালতে একাধিক মামলাও করেছেন মোতালিব।
অ্যাডভোকেট শাহনাজ পারভীন শ্রীপুর বার্তাকে বলেন, বাবা অনেক কষ্ট করে জমিটুকু কিনে ছিলেন। এটুকুই সম্বল ছিল। তিনি জানান, এই জমি জবরদখল হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা অন্ধকার দেখছেন। প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো কিনারা হচ্ছে না।
শ্রীপুর থানার নবাগত ওসি জাবেদুল ইসলাম বলেন, গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছেন। যাচাই প্রক্রিয়া চলছে। খুব শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ সুপারকে পাঠানো হবে।
এ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত সৈয়দ হুমায়ূন কবীর দাবি করেন, এ জমি দখলের সঙ্গে জসীমের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তাছাড়া এতকাল যারা জমিটি দখল করে রেখেছিল, তাদের মালিকানা নেই। জমির প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে তিনি এটি কিনেছেন।
শুধু মোতালিবের জমিই নয়, পাশের প্রায় সাত বিঘা জমিও জসিমের হস্তক্ষেপে দখল করে নেয় তার বন্ধু কামরুজ্জামান খসরু। দুই বন্ধুর বাড়ি একই গ্রামে। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে। মাওনা চৌরাস্তার ফকিরবাড়ির প্রায় ৩৫ কোটি টাকা মূল্যের ওই জমি প্রকাশ্যে দখল করে খসরু। পরে জানা যায়, ৫ লাখ টাকায় জমি দখল করে দেয় জসিম। জমিতে থাকা বড় বড় ভবন, মার্কেট, বসতবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে সেখানে তৈরি করা হয়েছে পুকুড়।
যদিও খসরুর দখল করা ওই জমি এখন হুমায়ূনের দখলে। কারণ খসরুর এখন আর কোনো সন্ধান নেই। ভোক্তভোগীদের তথ্যমতে, সম্প্রতি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে করাগারে পাঠিয়েছিল। বেশ কিছুদিন জেলে থাকার পর বের হয়ে সে গা-ঢাকা দিয়েছে। ওই জমিতেও সে আর এখন যায় না। কাজল ফকির, মজনু ফকির, গাফফার কিংবা ওয়াজ কুরনীরাও এখন এলাকায় নেই।
শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগে সাবেক সভাপতি কামাল ফকির বলেন, জমি দখলে আসার এক সপ্তাহ আগে পরিবারের সদস্যদের আসামি করে একাধিক চাঁদাবাজি মামলা করে খসরু। এরপর বাড়িতে অভিযান চলতে থাকে। তার বংশের কোনো পুরুষ রাতে বাড়িতে থাকতে পারত না। এমন অবস্থার সৃষ্টি করে ২০১৬ সালের ১৯ জুন দিনদুপুরে সশস্ত্র মহড়া দিয়ে দাদার ৯ ছেলের ৭ বিঘা জমি দখলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। যার বাজারমূল্য ৩৫ কোটি টাকা। তিনি আরো বলেন, একপর্যায়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিভিন্ন মামলায় তাদের আদালতে পাঠানো হয়।
কামাল ফকির অভিযোগ করে বলেন, এ ব্যাপরে পুলিশের সহযোগিতা তো দূরের কথা, কোনো রাজনীতিকেরও সহযোগিতা পায়নি পরিবার।
ডিবি পুলিশের তৎকালীন ওসি আমির হোসেন বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে ডিবি পুলিশের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কি-না জানা নেই।
মারফত আলী ফকির জনায়, তাদের ওয়ারিশদার মজনু ফকির গংয়ের ১২ শতাংশ জায়গা ওখানে ছিল। সেই জমি কাজল ফকিরের মধ্যস্থতায় খসরুরর কাছে বিক্রি করে দেয়। পরে তাদের সাত বিঘা জমি দখলের পাঁয়তারা শুরু করে খসরু ও হুমায়ূন কবীর। আদালতে তারাও পরপর তিনটি মামলা করেছেন বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, তাদের জমিতে থাকা দোকান, ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় নিষেধ করেছিলেন। তখন এক সন্ত্রাসী এসে তার বুকে বন্দুক ধরে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। বন্দুক ধরার ঘটনা দেখে ঘটনাস্থলেই আমার স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ সময় জমির চারদিকে শত শত মানুষ দা, লাঠি ও পিস্তল নিয়ে মহড়া দিতে থাকে। জমি হারিয়ে তারা দিশেহারা। জমি ফিরে পেতে এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, পরদিন থানায় গিয়ে পুলিশের সহযোগিতা চাইলেও তা মেলেনি। এ ব্যাপারে শ্রীপুর থানার তৎকালীন ওসি আসাদুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে কিছু জানা নেই।
বর্তমানে জমির দখলদারিত্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরিবার গুলো জবরদখল হওয়া জমিগুলো ফিরে পেতে ভুক্তভোগীরা ঘুরছে প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনীতিক, এমপি-মন্ত্রীদের দ্বারে দ্বারে। কেনা ও পৈতৃক এসব জমি দীর্ঘদিনেও ফিরে না পাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গী এখন দীর্ঘশ্বাস। কবে ফিরে পাবে জমিটুকু তাই চাতকের মতো চেয়ে আছে তারা!